যে মন্দির ১০০০ বছরের নিদর্শন বহন করে | কান্তজীর মন্দির, দিনাজপুর

দিনাজপুরের এই অঞ্চল অত্যন্ত প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত একটি এলাকা, এরপরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন নিদর্শন । ১৭ শতকে নির্মিত মন্দিরটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে মন্দিরটি অবস্থিত।

কান্তজীর মন্দির

১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দ। দিল্লির সিংহাসনে তখন মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসন চলছিল। এ সময় দিনাজপুরের জমিদারি বেশ খারাপ সময় পার করছিল। পর পর দুই বড় ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে জমিদারির সিংহাসনে বসেন জমিদার প্রাণনাথ রায়। প্রাণনাথ রায় ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবথেকে ছোট। জমিদার হিসেবে প্রাণনাথ রায় ছিলেন বেশ প্রজাদরদী।

কিন্তু সিংহাসনে আরোহণের কয়েক বছর পর তাকে একটা বড় ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়।

সে সময় ঘোড়াঘাট অঞ্চলের জমিদার ছিল রাজা রাঘবেন্দ্র রায়। পারিরিবারিকভাবেই দিনাজপুরের জমিদার ও ঘোড়াঘাটের জমিদারির মধ্যে একটা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব ছিল। আর প্রাণনাথ সবে দুই ভাইয়ের ক্ষমতার পালাবদলের পর জমিদারি হতে নিয়েছেন, তাই রাঘবেন্দ্র রায়ের কাছে এটি বেশ ভালো সুযোগ ছিল। তিনি দিল্লির বাদশার কাছে চিঠি লিখে বসলেন। যার মর্মার্থ ছিল প্রাণনাথ পারিবারিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পর পর তার বড় দুই ভাই রামদেব ও জয়দেব কে হত্যা করে এবং সিংহাসন দখল করে। উপরন্তু তিনি একজন অত্যাচারী এবং প্রজাশোষি জমিদার। সবথেকে গুরুতর অভিযোগ ছিল তিনি মুঘল দরবারে নিয়মিত খাজনা পাঠান না এবং দিল্লির অধীশ্বর বাদশার প্রতি অনুগত নন।

কান্তজীর মন্দির

রাঘবেন্দ্র রায়ের এই ষড়যন্ত্র কাজে দিল। বাদশাহ আওরঙ্গজেব সমন জারি করলেন প্রাণনাথকে কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য। অগত্যা প্রাণনাথকে ছুটতে হলো হাজার মাইল দূরে দিল্লির পথে। যাওয়ার সময় তিনি তার সাথে দিনাজপুরের বিখ্যাত সুগন্ধি কাটারিভোগ চাল ও বহুমূল্য উপহার নিয়ে যান মুঘল বাদশাহর উপঢৌকন হিসেবে।

প্রাণনাথের নম্র-ভদ্র আচরণ ও বহুমূল্য উপহার পেয়ে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভুল ভাঙে। তিনি তাকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেন এবং মুঘল বাদশাহর প্রতি তার ভালোবাসা ও আনুগত্যে খুশি হয়ে আওরঙ্গজেব তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাকে পুনরায় সফলতার সাথে জমিদারি পরিচালনার আদেশ দেন সেই সাথে মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব স্বয়ং তাকে একটি কৃষ্ণমন্দির নির্মাণের আদেশ দেন।

পরবর্তীতে মহারাজা প্রাণনাথ রায় শ্রীকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী রুক্মিণীকে উৎসর্গ করে ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় মন্দির নির্মাণের কাজ। মন্দির নির্মাণ এবং সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সুদূর পারস্য ইরান থেকে দক্ষ নির্মান শিল্পীদের আনা হয়। এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সেজন্য রাজা প্রাণনাথ শ্রমিকদের বসবাস এবং ধর্মীয় প্রার্থনা পালনের জন্য মন্দিরের দক্ষিণ দিকে নয়াবাদ নামক গ্রামে জমি দান করেন যা একই এলাকার আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।

কান্তজীর মন্দির

উচু বেদির উপর কারিগরদের অসামান্য দক্ষতায় চলতে থাকে মন্দির নির্মাণের কাজ। একসময় জীবনের শেষদিকে চলে আসেন প্রাণনাথ রায় এবং ১৭২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। রাজা প্রাণনাথ রায়ের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না তাই তার মৃত্যুর পর রাজ্য ভার গ্রহণ করেন তার পোষ্যপুত্র রাজা রামনাথ রায়। সিংহাসনে বসার পর বাবার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তিনি মন্দির নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিতে থাকেন। দীর্ঘ ৪৮ বছর মন্দির নির্মাণ কাজ চলমান থাকে এবং ১৭৫২ সালে মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।

নির্মাণকৃত মন্দিরে মোট নয়টি চুড়া থাকার কারণে একে অনেকেই নবরত্ন মন্দির নামে ডাকেন।

১৮৯৭ সালে মন্দিরটি বেশ বড় ভূমিকম্পের কবলে পড়ে এবং এর চুড়াগুলো ভেঙে যায়। সে সময়ের জমিদার মহারাজ গিরিজানাথ মন্দিরটির ব্যাপক সংস্কার করলেও শেষপর্যন্ত চূড়াগুলো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।

১৯৬০ সালে সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিভাগ এই মন্দিরকে প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। সেই থেকেই এই পুরাকীর্তি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কতৃক সংরক্ষিত হয়ে আসছে। তবে এখানে বলে নেওয়া ভালো প্রাণনাথ রায়ের আনা কৃষ্ণমূর্তিটি কিন্তু এখন আর নেই। এক রাসযাত্রার সময় মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। অনেকের মতে ভূমিকম্পের সময়েই চুরি যায় মূর্তিটি।

মন্দিরের বাইরের দেয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী চিত্রায়ণ করা আছে। পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫,০০০-এর মতো টেরাকোটা টালি রয়েছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে। বাংলাদেশে যত পুরনো মন্দির রয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

অর্চনা মন্দির

যে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনাটি দেখতে পাচ্ছেন সেটি হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্চনা মন্দির বা অর্চনা শিব মন্দির, এই মন্দিরটি টি কান্তজি মন্দিরের ঠিক পিছনে অবস্থিত। এই মন্দিরে ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে, রয়েছে ছোট ছোট জানালা। মন্দিরটি একটি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল যা এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।

প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক মন্দিরটি দেখতে ভিড় জমান। নির্মাণশৈলীর জন্য দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মধ্যে এই প্রাচীন মন্দিরের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। স্থাপত্য রীতি, গঠনবিন্যাস, শৈল্পিক মন্দিরটির সামগ্রিক দৃশ্যকে এতই মাধুর্যমন্ডিত করে তুলেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন