কেন হিন্দু রাজা তৈরি করেছিলেন এই মসজিদটি | নয়াবাদ মসজিদ দিনাজপুর

 তাদের সবাই ছিল মুসলিম, মন্দির নির্মাণের কাজে এসে করেছিলেন মসজিদ নির্মাণ , এমনি এক বিরল ঘটনার সাক্ষী দিনাজপুরের নয়াবাদ মসজিদটি

মুসলিম প্রততাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল। এই অঞ্চলে রয়েছে সুলতানি ও মোগল আমলের অসংখ্য মুসলিম প্রত্ননিদর্শন। তেমনি এক প্রাচীন মুসলিম প্রত্ননিদর্শন হলো দিনাজপুরের নয়াবাদ মসজিদ। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাহারোল উপজেলার ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ।

ইতিহাস এবং মসজিদের প্রবেশপথে স্থাপিত প্রাপ্ত শিলালিপি অনুসারে থেকে জানা যায়, ১৭০৪ সালে দিনাজপুরের তৎকালীন শাসক মহারাজা প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে কান্তনগর মন্দির বর্তমান কান্তজীর মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রায় টানা ৪৮ বছর মন্দিরের নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকে। মন্দির নির্মাণের জন্য মধ্যপ্রাচ্য খুব সম্ভবত মিসর থেকে একদল দক্ষ কারিগর আনানো হয়। কারিগরদের সবাই ছিলেন মুসলমান ও ধর্মপ্রিয়। পরবর্তীতে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের মৃত্যুর পর তার রাজ্য ভার গ্রহণ করেন তার পোষ্যপুত্র রাজা রামনাথ রায়।

মন্দির নির্মাণকালীন সময়ে মন্দিরের পাশেই খোলা আকাশের নিচে নামাজ আদায় করতেন কারিগররা। এরই মধ্যে কারিগরদের প্রধান হেডমিস্ত্রি নেয়াজ অরফে কালুয়া মিস্ত্রি মহারাজার দরবারে গিয়ে সব মিস্ত্রিদের থাকা ও ধর্ম পালনের নিমিত্তে একটি মসজিদ নির্মাণের জায়গা চান।  

এ সময় মহারাজা রামনাথ রায় মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে ঢেপা নদীর পশ্চিম কোল ঘেষে অবস্থিত নয়াবাদ গ্রামে ১.১৫ বিঘা জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য জায়গা দেন। এ ছাড়া মসজিদের পাশে কারিগরদের থাকার জন্য বাড়ি করার নির্দেশ দেন।  

মহারাজার নির্দেশ মোতাবেক মিস্ত্রিরা মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ গ্রামে নিজেদের থাকার বাড়ি ও নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীতে ২ জ্যৈষ্ঠ ১২০০ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয় এই মসজিদ নির্মাণের কাজ। তবে মসজিদ ও মন্দিরের নির্মাণকালের ভিন্নতা প্রায় ৫০ বছরের পার্থক্য তাই এই জনশ্রুতির সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

জনশ্রুতি অনুসারে মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষে আরব নির্মাণ শ্রমিক ও কারিগরদের বেশির ভাগ দেশে ফিরে গেলেও প্রধান কারিগর নেওয়াজ ওরফে কালুয়া ও তার ছোট ভাই এই দেশে থেকে যান এবং স্থায়ীভাবে বসবাস ও জীবিকা নির্বাহের জন্য মহারাজার কাছে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু জমির আবদার করেন। তাৎক্ষনিক মহারাজা কিছু জমি তাদের দুই ভাইকে দান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মিসরীয় এই দুই ভাই নয়াবাদ মসজিদ পরিচালনা এবং মহারাজের দানকৃত জমিতে ফসল আবাদ করে দিনযাপন করেন। 

কালুয়া মিস্ত্রির কবর 

মৃত্যুর পর কালুয়া মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাইকে নয়াবাদ মসজিদ সংলগ্নে দাফন করা হয়। তাদের কবর এখনো সংরক্ষিত আছে। এই মিস্ত্রিদের নামনুসারে অত্র এলাকার নাম হয় নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়া। বর্তমানে মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের হেড মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাইয়ের বংশধররা নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় বসবাস করছে।  

আয়তাকার নয়াবাদ মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদের তিনটি অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজের মধ্যে মধ্যেরটি অন্য দুটির তুলনায় কিছুটা বড়। এর চারকোণায় রয়েছে চারটি অষ্টভূজাকৃতির টাওয়ার। বাইরের দিক থেকে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১২.৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫.৫ মিটার। দেয়ালের প্রশস্ততা ১.১০ মিটার। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলান। মাঝের খিলানের উচ্চতা ১.৯৫ মিটার, প্রস্থ ১.১৫ মিটার। উত্তর-দক্ষিণে মসজিদটিতে একটি করে জানালা রয়েছে। দরজা-জানলার খিলান একাধিক খাঁজযুক্ত। যার ভেতরে পশ্চিমাংশে আছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মেহরাবের তুলনায় দুই পাশের মিহরাব দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট। মাঝের মেহরাবের উচ্চতা ২ দশমিক ৩০ মিটার ও প্রস্থ ১ দশমিক ৮ মিটার। মসজিদজুড়ে আয়তাকার বহু পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। পোড়ামাটির নকশাগুলো বহু জায়গায় খুলে পড়েছে। ফলকগুলোর মধ্যে লতাপাতা ও ফুলের নকশা রয়েছে। এরূপ মোট ১০৪টি আয়তাকার ফলক রয়েছে। তবে ফলকের মধ্যে অলংকরণের অনেকটাই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন