এক ভিন্নধর্মী মাটির স্কুল, দীপশিখা মেটি স্কুল দিনাজপুর

 দিনাজপুর মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রাপুর গ্রামে দীপশিখা মেটি স্কুলটি অবস্থিত। রুদ্রাপুর শহর থেকে দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও এই স্কুলটি নির্মাণের পর থেকে অনেকের কাছেই এখন গ্রামটি পরিচিত। রুদ্রাপুর বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও স্কুলটির কল্যাণে এখন দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে বিখ্যাত এই গ্রাম টি।

Photo

১৯৯৯ সালের আগে এই গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাশের গ্রামে যেত পড়ালেখার জন্য। এই কষ্ট দূর করার জন্য এবং গ্রামের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য দীপশিখা নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রুদ্রাপুর গ্রামে ছোট্ট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ গড়ে তোলে। মেটি মূলত একটি সংগঠনের নাম। পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)।

পরবর্তীতে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানির ‘শান্তি’ দাতা সংস্থার অনুদানে বিরল উপজেলার রুদ্রাপুর গ্রামে অত্যাধুনিক মাটির স্কুলঘর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণকালে অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এ স্কুল নির্মাণ কাজে সহায়তা করেন। সহযোগিতা করেন দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরাও। এই ভবনের নকশা করেন জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার ও এইকে রোওয়ার্ক। জার্মান ও অস্ট্রিয়ার ১০ জন ছাত্র ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় ১৯ জন শ্রমিকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে দীপশিখা মেটি স্কুল।

মেটি স্কুল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু, বাঁশ, দড়ি, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভবনগুলোর দেয়াল, যাতে দেয়ালে ফাটল ধরতে না পারে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি দেয়ালে লাগলে খড়ের জন্য তা নেমে যাবে। দেয়াল তৈরির পর সুন্দর করে সমান করা হয়েছে। দেয়ালের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের প্লাস্টারের জন্য পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রুফ। বাইরে থেকে প্লাস্টার না করায় স্বাভাবিকভাবে উপকরণগুলো চোখে পড়ার মতো।

মেটি স্কুল ছয় কক্ষবিশিষ্ট মাটির তৈরি একটি দোতলা ভবন। স্কুলটির আয়তন আট হাজার বর্গফুট। ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ টাকা। অথচ ইট, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করলে ব্যয় হতো প্রায় এক কোটি টাকা। ভবনের ভেতরে রয়েছে শীতের দিনে গরম আর গরমের দিনে ঠান্ডার ব্যবস্থা।

উপরে যেই মাটির ভবনটি দেখতে পাচ্ছেন এটি মূলত একটি একাডেমিক ভবন। এই ভবনটিতে সাধারণত প্রাইমারি সেসনের শিক্ষাথীদের ক্লাস কার্যক্রম পরিচালন করা হয়।

বর্তমানে এই স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এই স্কুলের উদ্দেশ্য হলো আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষা গ্রহণ। এছাড়াও এখানে ছাত্রছাত্রীদের নাচ, গান, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা এবং ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন হাতের কাজও শেখানো হয়।


ভবনের পেছনে রয়েছে ‘আনন্দালয়’ নামের কমিউনিটি থেরাপি কেন্দ্র। নিচ তলা পুরোপুরি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যবহার হয়। ঘরের ভেতর রয়েছে মাটির তৈরি গুহা। এতে শিশুরা খেলাধুলা করে। গুহার ভেতর চলাফেরার জন্য প্রতিবন্ধীদের এক ধরনের ব্যায়াম হয়ে যায়, এটি তাদের চিকিৎসারই একটি অংশ। ভবনের ভেতরে সহজেই আলো-বাতাস যাওয়া-আসা করতে পারে এবং ঘরগুলো পরিবেশবান্ধব। প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুবিধার্থে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। দ্বিতল ভবনে প্রতিবন্ধীরা ও হুইলচেয়ার ব্যবহার করে অনায়াসে একটি কক্ষ থেকে অন্যটিতে এবং একতলা থেকে আরেক তলায় যাতায়াত করতে পারে, সেজন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে নকশা সাজানো হয়েছে।

মাঠ থেকে একটু পেছনে গেলে দুই তলার একটি লাইব্রেরি চোখে পড়ে। লাইব্রেরিটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে দেখে মনে হবে ডুপ্লেক্স কোনো বাড়ি। যেহেতু স্কুলটি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, তাই একটি বড় কক্ষে অনেক সেলাই মেশিন দেখা গেল।

২০০৮ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থাপত্যের সাথে মেটি স্কুলকে আগা খান অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার হিসেবে দীপশিখাকে দেয়া হয় ১৩ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া অ্যানা হেরিঙ্গার ২০০৯ সালে এই ভবনটি নকশার জন্য কারি স্টোন নকশা পুরস্কারে ভূষিত হন।

পরিবেশবান্ধব এই স্কুলটির নির্মাণশৈলী সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সবুজের মাঝে একেকটি ভবন দেখে মনে হয় প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই যেন তৈরি করা হয়েছে চমৎকার এই দীপশিখা মেটি স্কুলটি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন