রাজশাহী শহরে বিদ্যমান লোকায়ত ইমারত সমূহের মধ্যে সর্বপ্রাচীন বড়কুঠি নামক প্রত্ন ইমারতটি রাজশাহী কলেজের দক্ষিণে পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। বলতে গেলে রাজশাহী শহরকেন্দ্রিক প্রাচীন ও উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্বিক নিদর্শণের পরিচিতি লাভ করে এটি। একে কেন্দ্র করেই কার্যত রাজশাহী শহরের গড়ে উঠা।

সুনির্দিষ্টভাবে এই ইমারতের নির্মাণকাল নির্ধারণ করা না গেলেও বিভিন্ন সূত্রের বিচারে এর নির্মাণকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে (১৭২৫ সালের আগে) বলে ধারণা করা হয়। তবে এটা নিশ্চিত যাই যে রাজশাহীর বড়কুঠি নির্মিত হয় রানী ভবানীর আমলে। অষ্টম শতকের প্রথমভাগে বড়কুঠি ওলন্দাজাদের এই অঞ্চলের বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।ইতিহাস থেকে জানা যায়,১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখল করলে ওলন্দাজরা মিরজাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ইংরেজদের ক্ষমতা খর্ব করতে চাইলে ইংরেজদের হাতে তাদের পরাজয় ঘটে। এরপরও তারা রাজশাহী অঞ্চলে কিছু দিন রেশম ব্যবসা করে ছিল। রাজশাহী শহরে রেশম ও নীল ব্যবসার সুবাদে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় ডাচ, ফরাসি ও ব্রিটিশ ইস্ট-ই-িয়া কোম্পানির আগমন ঘটে এবং তারা রাজশাহী শহর ও এর আশেপাশে কুঠি নির্মাণ করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
![]() |
বড়কুঠি ইমার |
পরবর্তী সময়ে রাজশাহীতে ওলন্দাজদের বড়কুঠি ক্রয় করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। কোম্পানীর একজন প্রতিনিধি বসবাস করতে আরম্ভ করেন বড় কুঠিতে। ১৮৩৩ সালে ওলন্দাজরা পরিত্যাগ করলে বড়কুঠি ইংরেজদের মালিকানায় চলে আসে। পরবর্তীতে ১৮৩৫ সালে বড়কুঠি মেসার্স রবার্ট ওয়াটশন অ্যান্ড কোম্পানীর হাতে চলে যায়। রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানী রাজশাহী ও সরদহের কুঠিবাড়ি কিনে নেয়। রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি এ সময়ে রাজশাহীতে প্রায় একচেটিয়া রেশম ও নীলের ব্যবসায় নিয়ােজিত ছিল।
রেশম ও নীল ব্যবসাকে নির্ভর করে রাজশাহী হয়ে ওঠে একটা সমৃদ্ধ নদী বন্দর। এখান থেকে প্রচুর রেশম ও নীল বিদেশে চালান হতে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ওলন্দাজ বাবসায়ীরা জরুরি সময়ে এই বড়কুঠি ইমারতটি দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করত। এ জন্য ইমারতের ছাদে এবং নিচে বেশ কয়েকটি কামান শত্রুদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকত।
১৮৩৩ সালে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে এলে কামানগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। এখানকার তিনটি পুরনো কামান এখনো রাজশাহী পুলিশ লাইন এ সংরক্ষিত আছে।
ইউরোপীয় বাজারে বাংলার রেশম বিদেশী রেশমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয় এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক শহর হিসাবে রাজশাহীর অবনতি ঘটে। ১৮৯০ সালে জার্মানীতে হিউম্যান (Heumann) খুব সস্তায় কয়লা থেকে নীল তৈরীর কৌশল আবিস্কার করে। এর ফলে নীল গাছের পাতা থেকে নীল রঙ তৈরী আর লাভজনক ছিল না।
এই কোম্পানী রাজশাহী মহানগরীর যে স্থানে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর বাজার বসাত তা এখনও সাহেব বাজার হিসাবে খ্যাত।
১৮৯৭ সালের প্রবল ভূমিকম্পে বড়কুঠির বেশ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। রাজশাহী মহানগরীর সবচেয়ে পুরনো দালান হয়েও অনেকবার সংস্কারের কারণে আজও টিকে আছে।
সে সময় নীচের কামরাগুলো রেশমের গুদাম ও উপরের কামরাগুলো আবাসিক কাজে ব্যবহৃত হতো। ওলন্দাজদের আমলে কুঠিটি ছিল বেশ সুরক্ষিত। ছাদের ওপরে বিশেষ ধরনের কামান স্থাপন করা ছিল নিরাপত্তার জন্য। নীচের ঘরগুলোই গোলাবারুদ রাখা হতো। আঙ্গিনাতেও বসানো ছিল ছোট ছোট কামান । পরে এগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিল্পবের সময় বড়কুঠি ইংরেজদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিশেষ হেড কোয়ার্টার রূপে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এই দোতলা ভবনটার পূর্ব ও পশ্চিম দিকে রয়েছে দুটো ঘোরানো সিঁড়ি। এই সিঁড়ি দুটো ভবনটার মাটির নিচে চলে গেছে। আর মাটির নিচে রয়েছে এক বিশাল বড় রুম। এই মাটির নিচের রুমের ভেতর দিয়ে পদ্মা নদীর তলা দিয়েছিল এক বিশাল বড় একটা রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে নাকি একসাথে ১০টা ঘোড়া দৌড়াতে পারত। আর এ পথটার শেষ মাথা ছিল বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার রাজবাড়ি পর্যন্ত। এখন অবশ্য কর্তৃপক্ষ সিঁড়ি দুটোর নিচের দিকে অর্ধেক প্রাচীর দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে রেখেছে।
ভবনের ভেতরের জেলখানা |
ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে ওয়াটসন কোম্পানীর আমলে নীচের ঘরগুলোকে বন্দিশালা হিসাবে ব্যবহার করা হতো ,নীলকর ইংরেজ কর্তৃক নীল চাষে অবাধ্য কৃষকদের ধরে এনে এ বড়কুঠিতে আটকে রেখে নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘঠিত হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া জনশ্রুতি আছে, ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহকালে এই ভবনটি কিছুদিন বিদ্রোহীদের কব্জায় ছিলো। তবে বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে এটি আটককৃত বিদ্রোহীদের নির্যাতন গৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ভারতবর্ষ ব্রিটিশ উপনিবেশের থাবা মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের জম্ম হওয়ার পর ১৯৫১ সালে তৎকালীন সরকার বড়কুঠি একোয়ার করে নেয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বড়কুঠি ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস ও বাসভবনে পরিণত হয়। নীচতলা অফিস ও ওপর তলা বাস ভবন। বতমার্ন বড়কুঠির নীচতলা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়ক কর্মচারী ইউনিয়নের অফিস ও উপরতলা টিচার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।